অরুণাচলে গাড়ি’গিরি’…কলকাতা থেকে অরুণাচল…চার চাকায় এক রম্য ট্রিপ জার্নাল…পার্থ দাশগুপ্তর কলমে | The 4th Column

অরুণাচলে গাড়ি ‘ গিরি ‘… কলকাতা থেকে অরুণাচল…চার চাকায় এক রম্য ট্রিপ জার্নাল ( চতুর্থ পর্ব )
_____________________________________________
দিরাং মনেস্টারির চৌহদ্দির মধ্যেই ইতরজনের থাকার ব্যবস্থা আছে। খুবই নামমাত্র ব্যবস্থা কিন্তু মনেস্টারির ভেতরে থাকার সুযোগটা হারাতে চাইনি বলে ওখানেই বুকিং করে রেখেছিলাম। সেটা তো বাতিল করতেই হল আগের দিন। ঠিক হল, সিধে তাওয়াং যাবো বমডিলা আর দিরাং হয়ে।

— দিরাং এর পথে

পেমা খান্ডুকেই শুধোলাম, “আপনার জানাশোনা হোমস্টে আছে? থাকলে একটু ব্যবস্থা করে দিন না।” ফোনাফুনি করে ব্যবস্থা হল। আপা হোমস্টে। পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যাবে।

শেরগাঁও থেকে চুয়াল্লিশ কিলোমিটার উপরে বমডিলা। বমডিলা টাউনের ভেতর দিয়ে যাওয়া যায়। আবার বমডিলা পাস হয়েও যাওয়া যায়। আমরা টাউনের রাস্তাটাই ধরলাম। খুবই খাড়াই। আর সরু। উল্টোদিক থেকে একটা স্কুলবাস। এদিক থেকে একটা অ্যাম্বুল্যান্স। যে কোনো একটাই যেতে পারবে। আমরা নেহাত অ্যাম্বুল্যান্স-এর পেছনে ছিলাম তাই সটকে গেলাম।

— পাহাড়ের স্বাভাবিক পতন…ধ্বস

বমডিলা পাস আর টাউনের রাস্তাটা যেখানে মিশেছে সেখানেই সবাই একটু জিরিয়ে নেয়। আমরা একটা দোকানে গিয়ে খেতে চাইলাম, কিন্তু ওই সাড়ে সাতসকালে তাদের তখনো আড়মোড়া ভাঙেনি। পাপিয়া কেমনে জানি আধাঘুমন্ত মেয়েটাকে ম্যানেজ করে দু পাত্তর ম্যাগি আনিয়ে ফেললে। সঙ্গে অপেয় চা। কোঁত করে সে বস্তু গিলে আমরা ধরলাম দিরাং-এর চড়াই।

— ছিমছাম সরাইখানা!

দিরাং ঢোকার ঠিক আগেই পড়ে দিরাং-জং। জং মানে কেল্লা। যদিও নয়ের শতকে তৈরি সে কেল্লা ফতেহ হয়ে গিয়েছে বহুকাল হল। এখন তার সর্বাঙ্গেই জং-ধরা। খুঁজেপেতে একটা বাইকের দোকান আর একটা মুদি দোকানের মাঝখান দিয়ে বিস্তর খাড়া সিঁড়ি বেয়ে কেল্লার মূল ফটক দিয়ে ঢোকা গেল। কেল্লা একটা আছে বটে কিন্তু সেটা আমাদের কলকাতার বাড়ির সাইজের। সেটাকে ঘিরে বেশ কিছু বাড়ি যা শুধুমাত্র কাঠ আর পাথর দিয়ে গড়া। এই ছোট গ্রামটার নাম মনপা। নানারঙের কাঠের দরজা আর তার উপরে মেকশিফট কাঠের গাড়িবারান্দার ছাদে শুকোচ্ছে রাশি রাশি ভুট্টা।

— মায়েপোয়ে…লেন্সের পিছনে এই অধম

দিরাং মনেস্টারিতে থাকা যখন হলই না, তখন আর সেখানে গিয়ে কী হবে? অরুণাচলের পথে পথে মনেস্টারি ছড়ানো। একটা দেখা মানেই সবকটাই দেখা। বরং যাওয়া যাক সাংতি ভ্যালি। অভীকও পই পই করে বলে দিয়েছে, এটা যেন বাদ না পড়ে যায়।
অরুণাচল প্রদেশ ভারত-তিব্বত সীমান্তরাজ্য। গত আধ শতক ধরে চিন আর ভারত তাল ঠুকছে ‘এ জমি আমার’ বলে। ফলে অরুণাচলের পাহাড়ের রঙ যেখানে যা-ই হোক না কেন, আট আনা গাড়ির রঙ জলপাই। ফৌজিতে ফৌজিতে চাদ্দিক ছয়লাপ। একটা নয়নাভিরাম জায়গায় আমাদের গাড়ি রুকে কাগজপত্তর দেখা হল। তারপরেই শুরু হল জ্যাম। বিশাল বিশাল ট্রাকে চাপিয়ে মিসাইল ছোঁড়ার সরঞ্জাম চলেছে তিব্বত সীমান্তে। হাল্লার মন্ত্রীর ভাষায়, “আজ বাদে কাল যুদ্ধু, চাদ্দিকে তোড়জোড় চলছে”। এদিকে ডানদিকে কোন একটা ছোট সরু গলি যে দু হাত পেছনে নেমে গিয়েছে সাংতি ভ্যালির দিকে, সেটা আর খেয়াল নেই। কোথাও কোনো বোর্ডও নেই। গুগল ম্যাপই ভরসা।

— মনে হয়…নদীর বদলে এই পাহাড়’টাই কিনে নিই!

বিস্তর কসরত করে, পশ্চাদ্ধাবমান অজস্র গাড়িচালকের অভিসম্পাত কুড়িয়ে, ড্রাইভিং স্কিলের চরম পরীক্ষা দিয়ে, ওই বিসর্পিল জ্যামের মধ্যে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা সাংতি ভ্যালির রাস্তা ধরলাম। খরস্রোতা দিরাং নদীর পাশ দিয়ে ভয়ঙ্কর ভাঙাচোরা রাস্তা সামলে প্রায় দশ কিলোমিটার উজিয়ে সাংতি ভ্যালি। ধান, স্কোয়াশ আর কিউই-র চাষ হয়। আর চরে ভেড়া। আপনারা চোখ বুজে কাশ্মীরের কথা ভাবুন। সাংতি ভ্যালি দেখা হয়ে যাবে।

গতকাল ছোকরা ঠিকই বলেছিল। রাস্তা একেক জায়গায় এমন বেহাল যে, কাল গাড়ি নিয়ে আসাটা অবিমৃশ্যকারিতাই হত। সে সব টপকে, রত্না ক্যাম্পের কেলজ্যাং রেস্তোরাঁয় চমৎকার লাঞ্চ সেরে যখন আবার মসৃণ রাস্তায়, সামনে আবার জ্যাম। এবারে কী? জ্যামের মুখে গিয়ে দেখলাম ধপাধপ পাথর গড়িয়ে পড়ছে ডানদিকের পাহাড় থেকে। আর ফৌজিদের দল দুটো জেসিবি নিয়ে টপাটপ সেগুলো ফেলছে বাঁ দিকে, নীচের খাদে। চল্লিশ মিনিটে রোড ক্লিয়ার।

তাওয়াং ঢোকার আট কিলোমিটার আগে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছে। গুগলের দেখানো বাঁ দিকের রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম আপা হোমস্টে। গোটা পরিবার দোতলা থেকে নেমে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করল। তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। পারদও সাড়ে আট ডিগ্রি।

(ক্রমশ…)

Leave a Reply

You cannot copy content of this page

error: Content is protected !!