অরুণাচলে গাড়ি ‘ গিরি ‘… কলকাতা থেকে অরুণাচল…চার চাকায় এক রম্য ট্রিপ জার্নাল… পার্থ দাশগুপ্তর কলমে (পঞ্চম পর্ব )
############
চোদ্দ আনা ট্যুরিস্ট অরুণাচলে যায় বুমলা পাস দেখবে বলে। পনেরো হাজার দুশো ফিট উঁচুতে তিব্বত-ভারত সীমান্ত, যেখান দিয়ে ১৯৬২তে চিনা সৈন্য ঢুকে আমাদের কচুকাটা করেছিল। যদিও স্রেফ জনা বিশেক সৈন্য নিয়ে সুবেদার যোগীন্দর সিংহ সিংহবিক্রমে তাদের অনেকক্ষণ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। শেষ অবধি অবিশ্যি তিনি পাকড়াও হন এবং চিনারা ওঁকে বন্দীদশাতেই খুন করে। ওঁরই স্মৃতিতে তাওয়াং-এর ওয়ার মেমোরিয়াল। এই রাস্তা দিয়েই তারও বছর তিনেক আগে চিনাদের তাড়া খেয়ে দলাই লামা কিছু সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। বুমলা পাস গিয়ে আমাদের দেশের মানুষ তার দেশপ্রেমের ছাতিটা কয়েক ইঞ্চি ফুলিয়ে ফেরে।
তাওয়াং থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার এবং পাঁচ হাজার ফিট উঁচুতে এই একদা-দুর্গম পাস। কয়েকবছর আগে অবধি রাস্তা ছিল খুবই খারাপ আর বিপদসংকুল। কিন্তু মূলত ভারতীয় ফৌজের সুবিধের কারণেই এখন অনেকটাই ভালো।
এই পাসে যেতে গেলে ফৌজিদের কাছ থেকে একটা পাস লাগে। পাছে স্থানীয় ট্যাক্সিচালকদের পেটে টান পড়ে, তাই তাদের দাপটে অন্য রাজ্য থেকে আসা ভাড়ার গাড়িকে তারা পাস দেয় না। আমাদেরও অনেকেই বুঝিয়েছিলেন যে, নিজের গাড়ি তাওয়াং-এ রেখে ওখানকার ট্যাক্সি ধরে বুমলা যেতে হবে। আমরা কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, প্রাইভেট গাড়িকে পাস দেওয়া হয়। দুদিন আগেই অভীকও তার XUV 700 নিয়ে দিব্য ঘুরে এসেছে। অভীকই আমাকে বুঝিয়ে দিল, পাস কীভাবে পেতে হবে। ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর-এর আপিসে যে ভদ্রমহিলা এই কাজটা করেন, সকাল আটটার সময়ে নাকি তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে আপিস খুলে এই পাস বিতরণ করেন। অভীক সে বাড়ির লোকেশনের সঙ্গে ছবিও পাঠিয়ে দিলে, যাতে আমরা বিপথে না যাই।
সেজেগুজে গেলাম শ্রীমতি সুমিতা জোঙ্কে-র বাড়ি। ভদ্রমহিলা নিজেই আপিসের তালা খুলছিলেন। সুমিতাদেবীকে কোথায় পাবো সবিনয়ে জিজ্ঞেস করায় উনি দাঁত খিঁচিয়ে জানালেন, উনিই তিনি। তারপর গাড়ির কাগজপত্র, আমাদের তিনজনের আধার কার্ড, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স, আইএলপি-এর কপি জমা রেখে একটা কাগজে সে সবের কুলুজি লিখে গোল ছাপ্পা মেরে বললেন, “একশো টাকা”। পাঁচ মিনিটে পাস আমার হাতে।
বুমলার আগে ওয়াই জাংশন বলে একটা তেমাথার মোড় রয়েছে। সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার চড়াইয়ে বুমলা পাস আর ১৩ কিলোমিটার উৎরাইয়ে সাঙ্গেসতর লেক যা মাধুরী লেক নামেই খ্যাত। এক ভয়াবহ ভূকম্পের পর পাহাড় ধসে এক বিরাট গহবর তৈরি হয়। অরুণাচলের প্রশাসকেরা তাতে জল ঢেলে লেক বানিয়ে দেন। ১৯৯৭ সালে ‘কোয়লা’ ছবির ‘তনহাই তনহাই’ গানের সঙ্গে মাধুরী দীক্ষিত (এবং শাহরুখ খান) এখানে (এবং জঙ জলপ্রপাতের সামনে) নাচনকোদন করেছিলেন। সেই থেকে এর নাম মাধুরী লেক। পর্যটকেরা এক পাসে এই বুমলা আর মাধুরী লেক – এই দুই পাখিই শিকার করেন।
ওয়াই জংশনের মোড়ে এক লালপাগড়ি ফৌজি। স্রেফ বলে দিলে, আজ বুমলা পাস বন্ধ। চিনের সেনাকর্তাদের সঙ্গে আমাদের ডন-বৈঠক হচ্ছে। আপনারা কাল ফের আসুন। চোদ্দ হাজার ফিট উঁচুতে ফৌজির সঙ্গে পেঁয়াজি করা কোনো কাজের কথা না। আমরা ভেটকিবদনে মাধুরী লেকের পথ ধরলাম। পথে এক টলটলে লেকের ধারে সু-উচ্চ গুরুদ্বার। লঙ্গরের পায়েস আর চা খেয়ে মাধুরী লেক। গাড়িতে গাড়িতে গোটা পথটা ছয়লাপ। বেশ উঁচুতে গাড়ি রেখে মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার সঙ্গে নাচনকোদন করে লেকে পৌঁছে আমরাও বিস্তর নাচনকোদন করে ছবিছক্কা তুললাম।
বুমলা যাওয়া হল না। কিন্তু কুছপরওয়ার নেই ব্রাদার। কাল আবার যাবো। তাওয়াং নেমে এসে সর্বাগ্রে ছুটলাম সুমিতা দেবীর আপিসে। তালাবন্ধ। আবার ওঁর বাড়িতে। তালা খোলা। আজকের পাসেই কালকের তারিখ লিখিয়ে নিলাম।
এইবারে তাওয়াং শহরের প্রাণকেন্দ্র নেহরু মার্কেটে কোনোমতে গাড়ি গুঁজে সন্ধে হব-হব সময়ে লাঞ্চ। তারপরে ম্যান্ডেটরি শপিং সেরে হোমস্টের বিছানায় পপাত চ আর মমার চ।
( ক্রমশ )