জলধ্বংসের কোলে ডুয়ার্সের স্বর্গ: জলদাপাড়া বিচ্ছিন্ন, থমকে জীবন ও জীবিকা
নিউজডেস্ক, দ্য ফোর্থ কলাম, জলদাপাড়া, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ :
দুই দিনের টানা প্রবল বর্ষণ উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিকে এক লহমায় তছনছ করে দিয়েছে। পাহাড় থেকে ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলপথ—সর্বত্র এখন শুধুই হাহাকার ও বিপর্যয়ের চিহ্ন। প্রকৃতির এই তাণ্ডবে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় মানুষ, পর্যটকদের পাশাপাশি জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের গর্ব গণ্ডার ও হাতি হরিণ-সহ একাধিক বন্যপ্রাণী।
প্রবল স্রোতের কারণে নদীগুলি এখন আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। তোর্ষা, মালঙ্গি, হলং, বুরি তোর্ষা ও দিনাই নদীর উপত্যকায় বিস্তৃত জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান কার্যত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বনাঞ্চলের রাস্তাগুলি ডুবে যাওয়ায় এবং একাধিক সেতু ভেঙে যাওয়ায় মূল সংযোগপথ বন্ধ।
পর্যটকরা উদ্ধার, বন্ধ জঙ্গল পর্যটন
বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে জলদাপাড়ার মূল সংযোগপথে। হলং নদীর ওপরের কাঠের সেতুটি তীব্র স্রোতে সম্পূর্ণভাবে ভেসে যাওয়ায় জলদাপাড়া টুরিস্ট লজের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লজে আটকে পড়েন ২৫ জন পর্যটক।
সোমবার সকালে স্থানীয় প্রশাসন ও বনকর্মীদের তৎপরতায় তাঁদের উদ্ধার করা হয়। লজের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার নিরঞ্জন সাহার মানবিক উদ্যোগে আর্থ মুভারের সাহায্যে আটকে পড়া পর্যটকদের নদী পার করানো সম্ভব হয়। পর্যটকরা সুস্থভাবে উদ্ধার হলেও, এই মুহূর্তে লজটি পর্যটকশূন্য। বন দফতর জানিয়েছে, রাস্তা, সেতু ও পরিকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতির কারণে পর্যটক ও বনকর্মীদের সুরক্ষার স্বার্থে আপাতত জলদাপাড়ার জঙ্গল পর্যটনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
জীববৈচিত্র্যের কান্না: বিপন্ন গণ্ডারের রাজ্য
জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান রাজ্যের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল, যা বাংলার সবচেয়ে বেশি একশৃঙ্গ গণ্ডারের জন্য পরিচিত। সাম্প্রতিক গণনায় বৃদ্ধি পেয়েছে গণ্ডারকুল। কিন্তু এবারের অতি বর্ষণে এই বন্যপ্রাণীরাও নিরাপদ নয়।
ঘন শাল-সেগুনের বন, বালুময় নদীতীর এবং বিস্তীর্ণ তৃণভূমি এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নদীর জল উপচে ওঠায় বহু বনাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, গণ্ডার ও হরিণদের প্রধান আশ্রয় তৃণভূমি এখন জলের তলায়। বনকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, জলের তোড়ে বহু বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে, যদিও সঠিক পরিসংখ্যান এখনও আসেনি। এই ক্ষতি রাজ্যের জীববৈচিত্র্যের জন্য এক গভীর ক্ষত তৈরি করল।
আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা: দুর্গাপূজা মরশুমে বড় ধাক্কা
এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় এমন এক সময় এল, যখন প্রতি বছর দুর্গাপূজা ও তার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে জলদাপাড়ায় পর্যটকের ঢল নামে। বন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, শুধু অক্টোবর মাসেই গড়ে ৭,০০০ থেকে ৯,০০০ পর্যটক আসেন। এই সময়কালে জিপ ও হাতির সাফারি থেকে বনাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে। এবারের আকস্মিক দুর্যোগ স্থানীয় হোমস্টে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতির মেরুদণ্ডে বড় ধাক্কা দিল। উৎসবের মরশুমে আয়ের যে আশা ছিল, তা বর্তমানে অনিশ্চয়তায় ঢাকা।
বন দফতর জানিয়েছে, আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাস্তা ও সেতু মেরামতের কাজ শুরু হবে। গণ্ডারের রাজ্য আবার তার পুরনো ছন্দে ফিরবে—বনকর্মীরা এই আশাতেই দিন গুণছেন। কিন্তু আপাতত, ডুয়ার্সের এই প্রাকৃতিক আশ্রয়কেন্দ্রটি শুধু ধ্বংস আর ক্ষতির বোঝা নিয়ে নীরব হয়ে আছে।