অরুণাচলে গাড়ি’গিরি’… কলকাতা থেকে অরুণাচল…চার চাকায় এক রম্য ট্রিপ জার্নাল…কলমে পার্থ দাশগুপ্ত | The 4th Column

অরুণাচলে গাড়ি ‘ গিরি ‘… কলকাতা থেকে অরুণাচল…চার চাকায় এক রম্য ট্রিপ জার্নাল…কলমে পার্থ দাশগুপ্ত

( দ্বিতীয় পর্ব )

অক্টোবরের ৬ই৷ রবিবার। রাত সওয়া ন’টা৷ গাড়িতে তেল ভরে টাকা দিতে গিয়ে দেখি ওয়ালেটটা পকেটস্থ নেই৷ এমনিতে তাতে কিছু না৷ আমার মতো গরিবগুর্বোর পকেটে আর কতই বা টাকা থাকে৷ কিন্তু সেখানে রয়েছে আমার মহার্ঘ ড্রাইভিং লাইসেন্স৷ কানু বিনে গীত নাই৷ সে মাল সঙ্গে না থাকলে যাত্রা নাস্তি৷ অতএব সেটা আবার বাড়ি থেকে খুঁজেপেতে আনা হল৷ পাক্কা সাড়ে ন’টায় যমের অরুচি বৈষ্ণবঘাটা থেকে বদর বদর বলে রওনা দিলাম আমরা তিন ভেতো বাঙালি।

— রাতের পথ…

আলিপুরদুয়ারে থাকে সঞ্জীব, মিতা আর তাদের নিশান-টিটো পুত্রদ্বয়৷ সঞ্জীব সাংবাদিক-কাম-কিশোরকণ্ঠী গাইয়ে-কাম-হারমনিকা বাজিয়ে-কাম-পাখি-দেখিয়ে৷ মিতা জাঁদরেল সরকারি অফিসার৷ আপিস করতে যায় একমুখী পঁচাত্তর কিলোমিটার গাড়ি হাঁকিয়ে। শীতলকুচিতে। ওদের ওখানে প্রথম বুড়ি ছোঁওয়া৷

— অন্তবিহীন এই পথ!!!

আমাদের দুদিন আগেই ওদিকপানে গিয়েছে সদ্য আলাপী আর এক রাহগীর – অভীক বসু৷ সে জানালে ফালাকাটা থেকে আলিপুরদুয়ারের রাস্তা শোচনীয়৷ ফলে আমরা যেন ফালাকাটা থেকে একটু বেঁকেচুরে যাই৷ সঞ্জীবও সাক্ষী দিলে৷ তাই যদি হবে তা হলে ওদিক দিয়ে যাবোই বা কেন? ঘি যদি আঙুল বেঁকিয়েই তুলতে হয় তা হলে পুরো আঙুলটাই বেঁকাবো। ফুলবাড়ি বাইপাস ধরবোই না। সেবকের করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে ওদলাবাড়ি, মালবাজার, চালসা, নাগরাকাটা, বিন্নাগুড়ি, বীরপাড়া, হাসিমারা হয়ে, চাপড়ামারি, জলদাপাড়া আর বক্সার জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই যাবো। ঘন্টাদেড়েক বেশি লাগবে৷ সে লাগুক৷ এতখানি রাস্তায় দেড়ঘন্টা নস্যি৷ আর এ রাস্তাটা আমার বরাবরের পছন্দের৷

ডালখোলা থেকে ইসলামপুরের রাস্তায় (যাকে ইংরেজিতে বলে অ্যান এক্সকিউজ অফ এ রোড) গাড়ি চালানোর পর শিলিগুড়ির কুৎসিত জ্যাম পেরিয়ে করোনেশন ব্রিজ পেরোতেই যেন সবটা বদলে গেল – মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার দ্বারে৷ মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিমপারে৷ একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে, রবীন্দ্রনাথও এই চক্কর কেটেই ওই গানটা রচেছিলেন৷ তারপর সেটা গীতবিতানের প্রেমপর্যায়ে কামুফ্লাজ করে ঢুকিয়ে দেন৷ সেবক থেকে আলিপুরের রাস্তা যে কী শ্যামলসুন্দর, সে যে না গিয়েছে তাকে বর্ণনা করে বোঝানোর চেষ্টা বোকামো৷

— এই পথের মাঝে পড়ে থাকে …কাহাদের কথা?

রাতে বাড়ি থেকে ওই যেটুকু যা খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর আর বসে খাওয়া হয়নি কোথাও৷ পাপিয়া সমানে সরবরাহ করে গেছে চিড়ের পোলাও বিস্কুট চানাচুর আখরোট কাজু কিশমিশ আমন্ড আর কড়া কফি৷ রাতটা আমরা বাপব্যাটা ওই ফুয়েলেই টেনে দিয়েছি৷
কিন্তু করোনেশন ব্রিজ পেরোতেই চোঁ করে খিদে পেল৷ ওখানে আমাদের একটা চেনা রেস্তোরাঁ আছে৷ মোমো-থুকপা দারুণ বানায়৷ আগেও খেয়েছি৷ এবারেও সরকারিভাবে ব্রেকফাস্টটা ওখানেই হল৷

এদিকে সঞ্জীব বেচারা দেরি দেখে মিনিটে মিনিটে মনিটর করছে আমাদের যাত্রাপথ৷ “ফোন করতে থাকো” “লাইভ লোকেশন পাঠাতে থাকো” “এদিক ওদিক চা বাগানে বা জঙ্গলে ঢুকে পোড়ো না যেন”। সঞ্জীব তার পার্থদাকে চেনে৷ এ কম্মো যে আমার পক্ষে খুব অসম্ভব নয় ও জানে তা৷

দুপুরের ঝোঁকে জাতীয় সড়ক থেকে পূবে গোঁত্তা খেয়ে নেমে, বিস্তর সাইকেল, বাইক, টোটো আর উদ্দেশ্যহীন পথচারীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে আলিপুরদুয়ারে ঢুকে পড়লাম। জায়গাটার নাম ভোলার ডাবরি। একমুখ দাড়িগোঁফ আর অনেক কালের কালো ছোপছোপ-ওয়ালা বাইকে সওয়ার হয়ে সঞ্জীব দাঁড়িয়ে মোড়ের মাথায়৷ ওর পেছন পেছন মস্ত তিনতলা দালানকোঠায় ঢুকেই মনে হল, এবারে একটা স্নান দরকার৷
(ক্রমশ…)

Leave a Reply

You cannot copy content of this page

error: Content is protected !!